জিপি নিউজঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ ‘হজ কার্যক্রম ২০১৮’র (১৪৩৯ হিজরী) উদ্বোধন করতে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানো থেকে সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন।তিনি বলেন, ‘ধর্মের শিক্ষা মানুষের কাছে যেন উচ্চ আসনে থাকে সেটা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু কিছু লোক নিজস্ব স্বার্থে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের জন্য, সমগ্র মুুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে।’ শেখ হাসিনা সকালে বিমানবন্দর আশকোনা হজক্যাম্প এলাকায় এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এবার ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৮ জন হজযাত্রী পবিত্র হজব্রত পালনে মক্কা নগরীতে যাচ্ছেন।হজ কার্যক্রম উদ্বোধনের পর হজযাত্রীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী।জঙ্গি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু মানুষ যখন ইসলামের নাম নিয়ে সন্ত্রাসি কর্মকান্ড করে এবং জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে তখন বিশ্বে মুসলমানদের হেয় হতে হয়। ‘পবিত্র ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং এই ধর্মেই আছে সকল ধর্মের মানুষ স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ ধর্র্ম পালন করবে। আমাদের নবী করিম (সা:) ও সে কথা বারবার বলে গেছেন। কিন্তু, তারপরেও কিছু কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য ইসলামকে অবমাননা করা হয়। যে অধিকার কারোরই নাই’, – বলেন প্রধানমন্ত্রী।শেখ হাসিনা এসময় জাতির পিতার ভাষণের একটি উদ্বৃতি দিয়ে ইনসাফের ইসলাম কায়েমের জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের আগে এক ঐতিহাসিক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমরা ইনসাফের ইসলামে বিশ্বাসী। আমাদের ইসলাম হযরত নবী করীম (সা:) এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র।’ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বিএইচ হারুন, ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, রাজকীয় সৌদি দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আমির বিন ওমর সালেহ বক্তৃতা করেন।অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আনিসুর রহমান স্বাগত বক্তৃতা করেন এবং অনুষ্ঠানে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশম ইমাম মওলানা মিজানুর রহমান দেশ, জাতি এব মুসলিম উন্মহির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগগ্রতি এবং ‘৭৫’র ১৫ আগষ্ট শাহাদাৎ বরণকারি জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন।মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের পস্থ সামরিক ও বেসাসরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দূতাবাসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং হজযাত্রীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই অনুষ্ঠানে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং প্রতিবছর আমি অপেক্ষা করে থাকি যারা হজে যাবেন তাদের সঙ্গে একটু সাক্ষাত হবে এবং আপনাদের কোন অসুাবিধা থাকলে শুনে নেব এবং সেই সাথে আপনাদের দোয়াও চাইব।তিনি বলেন, আপনারা যাচ্ছেন আল্লাহর মেহমান হয়ে পবিত্র হজ পালনের জন্য। পবিত্র মক্কা ও মদীনা নগরীতে আপনারা যাবেন নবী করিম (সা.) পবিত্র রওজা পাক জিয়ারত করবেন। আপনারা ভালভাবে হজ পালন করে সুন্দর ও সুস্থভাবে যাতে ফিরে আসতে পারেন সেটাই আমাদের আকাঙ্খা।প্রধানমন্ত্রী এসময় ’৭৫’এর ১৫ আগষ্টের বিয়োগান্তক অধ্যায়ের উল্লেখ করে সেদিনের শাহাদত বরণকারীদের জন্য হজযাত্রীদের কাছে দোয়া কামনা করেন।তিনি বলেন, ‘আপনারা তাঁদের জন্য একটু দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাঁদের বেহেশত নসীব করেন।’জাতির পিতার হত্যাতান্ডের পর ছয় বছর তাঁকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয় নাই এবং ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর থেকে দেশে ফেরার পর থেকে তিনি দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, ‘আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। শুধু একটা লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি- আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করে গেছেন। কাজেই, এই দেশের মানুষষ দারিদ্র থেকে মুক্তি পাবে, সুন্দর জীবন পাবে, ভালোভাবে বাঁচার অধিকার পাবে- সেটাই আমার লক্ষ্য। এবং গত ৯ বছরে আপনারা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছেন দেশের কি পরিমান উন্নয়ন হয়েছে।’প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশে ইসলামের প্রচারে জাতির পিতার উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, কম খরচে হজ পালনের জন্য জাতির পিতা হিজবুল বাহার জাহাজ ক্রয় করেন এবং বিমানেও বাংলাদেশ থেকে প্রথম হজযাত্রী প্রেরণ করেন। যদিও সেসময় পর্যন্ত সৌদি আরব বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি তথাপি বঙ্গবন্ধুর সৌদি আরবের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের কারণেই এটা করা সম্ভব পর হয়েছিল বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বসহ আরব দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁর দূরদর্শীতায় বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ওআইসি’র সদস্যপদ লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে।জাতির পিতা নিজে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনিই প্রথম আইন করে দেশে মদ নিষিদ্ধ করেন। ঘোড়দৌড় ও জুয়া বন্ধ করেন। বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠানের শুরু ও সমাপ্তিতে কুরআন তিলাওয়াতের প্রচলন করেন।
দেশের হজ ব্যবস্থাপনায় অতীতের বিশৃঙ্খল অবস্থার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ১৯৮৪ সালে প্রথম ওমরাহ এবং পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে হজ পালনের সময় থেকেই হজযাত্রীদের সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাচ্ছেন। তখন প্রধানমন্ত্রী না হলেও সৌদি বাদশাহ্র রাষ্ট্রীয় প্রটোকল পেতেন। তিনি মিনাতে নিজে দেশের হাজি ক্যাম্পগুলো ঘুরে ঘুরে সমস্যা চিহ্নিত করে সৌদি বাদশাহকে অবহিত করার মাধ্যম সেসব দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
’৯৬ সালে সরকারে আসার পরই আওয়ামী লীগ সরকারিভাবে হাজিদের সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নেয় এবং এসব কাজে সৌদি সরকারও সর্বত সহযোগিতা করে এবং হাজিদের সুবিধার জন্য তারা অনেক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারই দেশে ডিজিটাল হজ ব্যবস্থাপনা, হজযাত্রী পরিবহন, মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবাসহ সকল ক্ষেত্রে পূর্বের সরকারগুলোর সময়কার যাবতীয় অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, ‘হজযাত্রীদের সুযোগ-সুবিধাদি বৃদ্ধিসহ হজব্রতপালন যেমন সুনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির আওতায় এসেছে, তেমনি প্রশাসনিক কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালেই তাঁর সরকার হজ উইং এর অফিস জেদ্দা থেকে মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনে স্থানান্তর করে। যেহেতু হজের সকল কার্যক্রম মক্কা থেকেই পরিচালিত হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এ সিদ্ধান্তের ফলে গত নয় বছরে হজ ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের সেবা প্রদান অনেক সহজতর ও উন্নততর হয়েছে এবং দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেছে।’
হজ বিষয়ক ওয়েব পোর্টাল এবং হজযাত্রীদের সেবা প্রদানকারী মোবাইল অ্যাপ্স প্রস্তুত করা, অনলাইন সুবিধা ব্যবহার করে সারাবছর জুড়ে হজযাত্রীদের জন্য হজের প্রাক-নিবন্ধন এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্নের ব্যবস্থাসহ হজযাত্রীদের পাসপোর্ট, ভিসা, আবাসন, মেডিকেল সুবিধা, সৌদি আরব গমন, প্রত্যাগমন ইত্যাদি বিষয়ে নানাবিধ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘হজযাত্রীদের সুবিধার্থে আমরাই প্রথম ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ৪০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে জেদ্দা হজ টার্মিনালে প্লাজা ভাড়া করছি।’
তিনি বলেন, হজযাত্রীদের চিকিৎসা সেবাসহ নানামূখী সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় হজ প্রশাসনিক দল, হজ চিকিৎসক দল, হজ সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবক দল এবং আইটি টিম রয়েছে।
বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে অতীতের অনিয়মকে দূর করাসহ বাংলাদেশ বিমানের বহরে নতুন ছয়টি উড়ো জাহাজ যোগ করে এবং সৌদি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে হজযাত্রী পরিবহনের উদ্যোগ গ্রহণ করায় তাদের সফর স্বস্তিদায়ক হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
‘এদেশে আওয়ামী লীগ সব সময় ইসলামের খেদমতে নিবেদিত,’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এদেশে ইসলামের প্রসারে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণের ফলে সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের দোড়গোঁড়ায় ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর সরকারই প্রথম সরকারি পর্যায়ে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে আরবি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পবিত্র কুরআনের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, মসজিদের ইমামগণকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কুরআনের শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন চলছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের বরাদ্দ ২২ শত ৭২ কোটি ৪ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সারাদেশের সকল উপজেলা পর্যায়ে মডেল মসজিদ কাম ইলামিক সেন্টার নির্মাণে তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৮৭২২ দশমিক ০৫ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণে ৮০ শতাংশ জায়গাও নির্ধারণ করা হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, এসব মসজিদ নির্মিত হলে সেখানে নামাজ ছাড়াও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, দ্বীনি দাওয়াতি কার্যক্রম, হেফজখানা, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরী, হজ্জযাত্রীদের প্রশিক্ষণ ও লাশ গোসলের ব্যবস্থা থাকবে।
সুত্র- বাসস