অধ্যাপক কাজী মুহাম্মদ মাইন উদ্দীন:
জিপি নিউজঃ বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীবৃন্দের চাকরী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং চলনসই মাসিক বেতন ভাতাদি প্রদানের জন্য শিক্ষা জাতীয়করণ প্রয়োজন। শিক্ষা জাতীয়করণ হলেই শিক্ষকবৃন্দের চাকুরী জাতীয়করণ হবে। আর এতে করে মানসম্মত শিক্ষা প্রাপ্তিও সম্ভব। কিন্তু আমাদের মত মাথাপিছু গড় নি¤œ আয়ের দেশে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় করণ সম্ভব কিনা তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। প্রকৃত অর্থে এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হল শিক্ষা জাতীয়করণ, অন্যটি হল চাকুরী জাতীয়করণ। তাই শিক্ষক সমাজকে স্পষ্ট করতে হবে তাদের দাবি কোনটি এবং সে ভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষা জাতীয়করণ কি ?
যে ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সমগ্র শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রনে রেখে শিক্ষার সমুদয় ব্যয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রদান করা হয়, তাহলো শিক্ষা জাতীয়করণ বা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ । এ ধরনের ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় যেমন বই-পুস্তক ক্রয়, শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফিসহ যাবতীয় ব্যয় বাবদ রাষ্ট্র নাম মাত্র খরচ ঐ শিক্ষার্থী পরিবার থেকে গ্রহন করে কিন্তু ব্যাপক খরচ রাষ্ট্র বহন করে এবং শিক্ষক কর্মচারী বেতন ভাতাদি রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে প্রদান করে।
চাকুরী জাতীয়করণ কীঃ
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে চাকরী হল প্রত্যাশিত বস্তু যেমন তিনি চাকরীর জন্য আবেদন করছেন। অন্যদিকে চাকুরী হল প্রাপ্ত বস্তু যেমন তিনি চাকুরী করছেন। চাকরি পেয়ে চাকুরী করতে হয়। তাই বেসরকারী শিক্ষকবৃন্দের চাকরী নয়; চাকুরী জাতীয়করণ করতে হবে। চাকুরী জাতীয়করণ হল এমন এক ব্যবস্থা যে ব্যবস্থার মাধ্যমে কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল গোষ্ঠীর বেতন ভাতা বাবদ প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নতুবা সরকারী কোন বিভাগ থেকে প্রচলিত নিয়মে পূর্ব হতে জাতীয়করণকৃত শ্রেনি গোষ্ঠীর ন্যায় প্রদান করা হয়। যেমন সরকারী কলেজ শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি প্রদান হয় রাষ্ট্রিয় কোষাগার থেকে এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা বেতন ভাতাদি প্রদান করা হয় স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে অথচ উভয় প্রকার কর্মজীবি গোষ্টি হল জাতীয়করণকৃত। এই হিসেবে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি বাবদ প্রাপ্ত সমূদয় অর্থ যখন রাষ্ট্রিয় কোষাগার বা সরকারী কোন বিভাগ কর্তৃক প্রচলিত নিয়মে প্রদান করা হবে তখন তা হবে শিক্ষক কর্মচারীদের চাকুরী জাতিয়করণ। এ ধরনের সংজ্ঞা থেকে আমরা চাকুরী জাতীয়করনের দুইটি ধারনা লাভ করতে পারি। একটি হল সরাসরি সরকারীকরণ; অন্যটি হল স্বায়ত্বশাসনের মর্যাদা দান। সরাসরি সরকারীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রিয় কোষাগার হতে কর্মজীবীদের বেতন ভাতাদি প্রদান করা হবে আর স্বায়ত্বশাসনের মর্যাদা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান সমূহ হতে উপার্জিত অর্থ থেকে কর্মজীবীদের বেতন ভাতা সহ আনুসাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে। কিন্তু বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের চাকুরী জাতীয়করনে যদি প্রথম ধারণাটি প্রয়োগ করা হয় তাহলে সমস্যা তৈরি হয়। সমস্যাগুলি দুটিক্ষেত্রে দেখা যায়। প্রথমত, স্কুলের ক্ষেত্রেঃ প্রতিযোগীতা মূলক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় গুলিতে কর্মরত শিক্ষকবৃন্দ তাদের জ্যৈষ্ঠতা, পদোন্নতি, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রভৃতি গ্রহনের ক্ষেত্রে কোন রকম প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষাবিহীন সরাসরি সরকারীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয়করণকৃত হওয়া শিক্ষদের কোন রকম ছাড় প্রদানে ব্যাপক অনাগ্রহ সৃষ্টি হবে। এই ধরনের অনাগ্রহ থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে সৃৃষ্টি হবে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য সরকার কোন ব্যবস্থা নিলে তা মাধ্যম পর্যায়ে আসার সম্ভবনা থাকবে। কিন্তু সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাটি ক্ষুদ্রাকায় হলেও কোন পক্ষের অনুকূলে পড়লে অন্যপক্ষ তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে; তাহলে সমস্যাটি রয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, কলেজের ক্ষেত্রেঃ আমাদের দেশে বর্তমানে তিন ধরণের শিক্ষক শ্রেনি কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করে চলছে। এরা হল বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) শিক্ষা ক্যাডার ভূক্ত শিক্ষক শ্রেনি, এমপিও ভুক্ত শিক্ষকশ্রেণি, এমপিও বিহীন শিক্ষক শ্রেণি। এই তিন শ্রেণির শিক্ষক সমাজের মধ্যে প্রথম শ্রেণির শিক্ষক সমাজ ব্যাপক প্রতিযোগীতামূলক তিন স্তর বিশিষ্ট বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা প্রদানের জন্য যোগ্যতা অর্জন করে শিক্ষায় সেবা প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করে। দ্বিতীয় পক্ষ বিশেষ সুযোগের মাধ্যমে অনেকটা অনুকূল ভাগ্যের কারনে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করে। আর তৃতীয় পক্ষ অত্যন্ত দূর্ভাগা কপাল নিয়ে চাকুরী পেতে ব্যর্থ হয়ে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে স্ব-উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে তদবির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি আদায় করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়ে। ফলে সরাসরি সরকারীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি জাতীয়করণ করা হয়, তাহলে এদের পরবর্তী পদক্ষেপগুলিতে জটিলতা তৈরী হবে। যেমন জ্যৈষ্ঠতা, পদোন্নতি তথা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্র সমূহে। এ ধরনের অবস্থায় প্রথম পক্ষ অন্য দুটি পক্ষকে অনাগ্রহ এবং বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে দেখা অত্যন্ত স্বাভাবিক – যা তাদের সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচায়ক হলেও যর্থাথ এবং বাস্তব। ফলে মাধ্যমিক পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রের কোন অংশে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিবে যা দেশের জন্য শুভ বয়ে আনবে না। বর্তমান সরকার কর্তৃক জাতীয়করণকৃত অনধিক ৩০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ্য করি। যা বেশ লজ্জাস্কর। একদিকে বেসরকারী শিক্ষকদের যোগ্যতা উত্থাপনের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা হানি, অন্যদিকে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে একটি মেধাবী গোষ্ঠীকে উত্তেজিত করে রিক্সাশ্রমিক বা পথশ্রমিকের মত আন্দোলনে বাধ্য করা হচ্ছে। দুই পক্ষের বর্তমান অবস্থানে বেদনায় ব্যথিত হতে হয় এবং এ ধরনের অপ্রত্যাশিত বা অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য মেধাহীন রাজনীতিকে দায়ি করা ছাড়া আর কোন গত্যান্তর থাকেনা । তাই এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় করণ একে বারেই বন্ধ করে দেয়ায় ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী।
এখন দেখা যাক দ্বিতীয় ধারনাটি প্রয়োগ করা হলে অর্থ্যাৎ স্বায়ত্বশাসনের মর্যাদা দানের মাধ্যমে জাতীয় করণ করা হলে কি ঘটতে পারে? আমরা জানি প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হল স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এগুলি জাতীয়করণকৃত। এখানকার শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতাসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির জন্য সরকারী কোষাগারের দরকার হয়না। পদোন্নতির জন্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রনালয়ের বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না; প্রতিষ্ঠানগুলিই যথেষ্ট। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবিদের জন্য যদি এরূপ একটি কনসেপ্ট তৈরী করা যায় তাহলে আমার মনে হয় সমস্যা তৈরী হবে না। বরং নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরী হবে। দেখুন ‘৯০এর দশকে যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তা ছিল নতুন কনসেপ্ট। বর্তমানে উহাকে আরো মডারেটের প্রক্রিয়া চলছে। ‘৮০ এর দশকে এমপিত্তভূক্তকরণ প্রক্রিয়া ছিল নতুন কনসেপ্ট। বর্তমান এসে এই কনসেপ্টটিকে আধুনিকীকরণ করতে হবে। ফলে উল্লেখিত দ্বিতীয় ধারনাটি বেঁচে নিতে হবে।
বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতা সহ বিভিন্ন ক্ষুদ্রাকায় আর্থিক সুবিধা এবং স্বল্প দৈঘ্যের পদোন্নতিসহ সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে। যদি এই প্রতিষ্ঠীনটি এরূপ কর্মকান্ড যথাযথ ভাবে পরিচালনা করতে পারে তাহলে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক কর্মচারীর পরিচালন-পরিতোষণও শিক্ষা অধিদপ্তরের প্যারালাল কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী করে করা যেতে পারে। এই ধারণা থেকে বর্তমানে এনটিআরসিএ এর আওতাভূক্ত করে সমস্ত বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের জাতীয় করণ করা যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সমুদয় আয় এনটিআরসিএ তহবিলে জমা হবে। শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতাসহ সর্বোচ্চ পদোন্নতির পদ সৃষ্টি করে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পদায়ন করা যেতে পারে। ফলে বিসিএস ক্যাডারভূক্ত কর্মকর্তাবৃন্দের সাথে এদের কোন রকম দ্ব›দ্ব সংঘাত তৈরী হবে না। সবাই আতœমর্যাদার সাথে শিক্ষার সেবা প্রদান করে যাবে। এতে করে বেসরকারী শিক্ষকবৃন্দ একটি নতুন ধারার স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন মর্যাদা সম্পন্ন শিক্ষার কারিগরে রূপান্তরিত হবে। এরা সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী হবে না। তাহলে নতুন ধারার স্বায়ত্ব শাসন কি? এর উত্তর হল: এমন একটা স্বায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠান হবে যাতে শিক্ষকবৃন্দ সমধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলীযোগ্য হবে; বদলী মহানগর ভিত্তিক, জেলা ভিত্তিক, মফঃস্বল ভিত্তিক হবে। এ সমস্ত স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতী, বদলী এনটিআরসিএ বা শিক্ষা অধিদপ্তরের প্যারারাল কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হবে। তবে বেতন ভাতাদি উহার মাধ্যমে অথবা উপজেলার প্রশাসন বা জেলা প্রশাসন বা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে হবে। উল্লেখ্য যে, উল্লেখিত যে প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয় গ্রহণ করবে তারাই এদের বেতন ভাতাদিসহ যাবতীয় আর্থিক সুবিধা জাতীয় নিয়মে প্রদান করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারী হবে না আবার সম্পূর্ণরূপে স্বায়ত্বশাসিতও হবে না। তবে উল্লেখিত নিয়মে জাতীয়করণকৃত হবে। তার এটাই হবে নতুন ধারার স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান।
প্রবন্ধ অনুসারে বলা যায় যে, দরিদ্র তথা উন্নয়নশীল এই দেশে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ কোন ভাবেই সম্ভব নয়। সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করলে ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষার বিস্তার বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় ধারাকে গ্রহণ করে শুধু এমপিও ভুক্ত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং উহার কর্মজীবিগণকে জাতীয়করণ করা যেতে পারে।
লেখকঃ
কলেজ শিক্ষক এবং বাকশিস নেতা
E-mail: kazimain@gmail.com