কাশ্মীরে একটা ‘ডার্টি ওয়ার’ বা নোংরা যুদ্ধ চলছে এবং ভারতীয় সেনারা তাতে নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না – সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াতের এই মন্তব্যকে ঘিরে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন, যে কোনও সংঘাতে দুপক্ষেরই অনেক গোপন যুদ্ধকৌশল থাকে – সেটাকে সামনে এনে সেনাপ্রধান হয়তো খুব একটা বিচক্ষণতার পরিচয় দেননি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মনে করছে, কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার নীতি গ্রহণযোগ্য নয় অনেক ক্ষেত্রেই – কিন্তু জেনারেল রাওয়াত সম্ভবত সেটাকেই এখন একটা বৈধতা দিতে চাইছেন।
“কাশ্মীরের বিক্ষোভকারীরা যদি পাথর না ছুঁড়ে গুলি ছুঁড়ত – তাহলে ভারতীয় সেনা অনেক বেশি খুশি হত”, সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের এই মন্তব্য চমকে দিয়েছে অনেককেই।
তার যুক্তি ছিল, কাশ্মীরে ডার্টি ওয়ার চলছে – কিন্তু পাথরের জবাবে সেনারা এতদিন গুলি ছুড়তে পারেনি। তবে এখন থেকে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনারাও পাল্টা নোংরামো করতে দ্বিধা করবে না, তার বক্তব্যকে অনেকেই সেই ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।
প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরী অবশ্য মনে করেন কাশ্মীরের সংঘাতে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মানার তেমন বাধ্যবাধকতাও নেই।
“আমার বক্তব্য হল, যে কোনও যুদ্ধই ডার্টি। জেনেভা কনভেনশন বা ওই জাতীয় অনেক কিছুই হয়তো আছে, কিন্তু আসল যুদ্ধের সময় সব যুদ্ধই নোংরা। ভিয়েতনাম বা বিশ্বের আরও নানা যুদ্ধই এর দৃষ্টান্ত। আর কাশ্মীরে যেটা চলছে সেটা একটা অভ্যন্তরীণ সংঘাত – এবং এরকম ক্ষেত্রে যে জেনেভা কনভেনশন প্রযোজ্য হয় না তার বহু উদাহরণ আছে।”
“অনেকেই বলেন জেনেভা কনভেনশন সে সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে দুপক্ষই উর্দি বা ইউনিফর্ম পড়ে লড়ছে। কাশ্মীরে এটা স্পষ্ট যে শুধু এক পক্ষেরই ইউনিফর্ম আছে। সেই ভারতীয় সেনারা কিন্তু একটা ক্লিন ওয়ার লড়ছে – তাদের প্রতিপক্ষ ফিদায়েঁরা কখনওই জেনেভা কনভেনশন মানার প্রয়োজন বোধ করেনি”, বলছিলেন জেনারেল রায়চৌধুরী।
এতদিন সরকারিভাবে ভারতীয় সেনার অবস্থানও ছিল ঠিক এটাই। কিন্তু ভারতীয় সেনাও এখন থেকে ডার্টি ওয়ারের দস্তুর মেনেই লড়বে – সে কথাটা উচ্চারণ করে সেনাপ্রধান অত্যন্ত বোকার মতো কাজ করেছেন, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ভারতের নামী প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদী।
তার যুক্তি হল, “উত্তর-পূর্ব ভারতই হোক বা পাঞ্জাব-কাশ্মীরের জঙ্গী দমনে – কিংবা মাওবাদীদের মোকাবিলায়, চিরকালই কিছু ধোঁয়াটে অনৈতিক ব্যাপারস্যাপার ছিল – কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কখনও মুখ খোলেনি। সবাই জানে চম্বলের ডাকাতদের নিকেশ করা হয়েছিল এনকাউন্টারে, তবে কেউ সেটা ঘোষণা করেনি।”
“জেনারেল রাওয়াত অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছেন কারণ এই কথাগুলো মুখে বলা যায় না – কিন্তু ওপেন সিক্রেট হল এই সব ডার্ক অপারেশনের ওপর সিআইএ বা ব্রিটিশরা সবাই নির্ভর করে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না”, বলছেন মি বেদী।
আর এই যে সেনাপ্রধানের ঘোষণা, এটাকে সেনাবাহিনীর অনৈতিক কাজকে কাশ্মীরে একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেই দেখছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
দক্ষিণ এশিয়াতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রধান মীনাক্ষি গাঙ্গুলি পরিষ্কার বলছেন সেনাবাহিনী বহুদিন ধরেই সেখানে পাথর নিক্ষেপকারী আর জঙ্গিদের একই চোখে দেখছে।
তার কথায়, “যারা আজ কাশ্মীরে পাথর ছুড়ছে তারা হল চিলড্রেন অব কনফ্লিক্ট। কুড়ি-বাইশ বছরের এই যুবকদের জন্ম আশির দশকের পরে, জন্মের পর থেকেই তারা শুধু হিংসা দেখছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন দেখছে। তাদের ডিল করার জন্য যে ধরনের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার বা হিলিং অ্যাপ্রোচ দরকার সেটা আমরা মোটেও দেখছি না।”
“সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল এদের সঙ্গে জঙ্গিদের মতো আচরণ করা হচ্ছে। হ্যাঁ নিশ্চয়, পাথর ছুড়ে তারা নিশ্চয় দেশের আইন ভাঙছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা উচিত। কিন্তু পাকিস্তান থেকে এসে যে জঙ্গিরা বন্দুক বা বিস্ফোরক নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে – তাদের সঙ্গে যদি এই ভারতীয় নাগরিকদের আপনি এক করে দেখেন, তাহলে শুধু গোটা একটা কাশ্মীরী প্রজন্মকেই আপনি আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন”, বলছিলেন মিস গাঙ্গুলি।
জেনারেল বিপিন রাওয়াত এখন পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এখন থেকে ভারতীয় সেনা এ ব্যাপারে আর কোনও রাখঢাক রেখে চলবে না – বুলেট দিয়েই হোক বা হিউম্যান শিল্ড, যেটাকে তারা ‘ডার্টি ওয়ার’ বলে মনে করছে সেটাকে সেই যুদ্ধের নিয়ম মেনেই লড়বে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছেন, এটা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনার কৌশলের সঙ্গেই তুলনীয় – তবে ফারাক হল ভারত কাশ্মীরে সেটা করতে চাইছে রীতিমতো বলেকয়ে!
সুত্র- বিবিসি