জিপি নিউজঃ এক হিসেবে দেখা গেছে, ৮১৬ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা শহরে বাস করে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ। কর্মঘন্টায় এই মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটির কাছাকাছি চলে যায়।
তবে ঢাকায় এখনও কোন সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় এই ঘনবসতিপূর্ণ শহরের বাসিন্দাদের প্রতিদিন সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়।
যাতায়াতে এই অসহনীয় পরিস্থিতির প্রধান কারণগুলোর একটি ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা এবং এই ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ঢাকা শহরে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরণের যানবাহনগুলোকে।
ঢাকায় ঠিক কতো ধরণের যানবাহন চলাচল করে সেটার সঠিক কোন হিসাব পাওয়া যায়নি।
সড়কে এই বিভিন্ন আকার ও গতিসীমার যানবাহনের চলাচলকে ‘হেটেরোজেনিয়াস ট্রাফিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড: মিজানুর রহমান।
বাইরের দেশগুলোতে দুই থেকে তিন ধরণের যান চলাচল করে যেগুলোর গতিমাত্রা প্রায় একই, তাই এদেরকে ‘হোমোজেনিয়াস ট্রাফিক’ বলা হয়। যেটা নিয়ন্ত্রণ করা অপেক্ষাকৃত সোজা।
এই হেটেরোজেনিয়াস ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বেশ জটিল অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “এসব যানের একেকটির প্রকৃতি একেক রকম।”
“এ কারণে সড়কে আলাদা লেন করলেও শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
ঢাকার বিভিন্ন যানবাহন
রিকশা
ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তের বাহন হিসেবে পরিচিত রিকশা।
মূল সড়কগুলোতে প্যাডেল দেয়া রিকশা চললেও অলি-গলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা যায়।
সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় প্রায় তিন লাখ রিকশা চলাচল করে। এর মধ্যে নিবন্ধন আছে মাত্র ৮৮ হাজার রিকশার।
সিএনজি অটোরিকশা
দ্রুত ও সহজে চলাচলের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত বাহন ফোর-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত সিএনজি অটোরিকশা।
এই যানগুলোর কিলোমিটার ও সময় হিসেবে মিটারে চলার কথা থাকলেও কোন চালকই সেই নিয়ম মানেন না।
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ১৩ হাজার। তবে প্রাইভেট নেমপ্লেট লাগিয়ে অনেক সিএনজি চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় চলাচল করে।
এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকেও বহু অবৈধ সিএনজি রাজধানীতে চলাচল করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হিউম্যান হলার
এই হিউম্যান হলারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ মাইক্রোবাস এবং পিকআপের নতুন সংস্করণ।
ফোর হুইলার এই গাড়িগুলোকে মূলত, ম্যাক্সি, লেগুনা এবং বন্ধু পরিবহন এই তিন নামে রাস্তায় চলতে দেখা যায়।
এদের পিকআপ টেম্পো বা মিনিবাস কোন ধরণের গাড়ির শ্রেণিতে ফেলা যায় না। এসব গাড়ির বেশিরভাগের কোন ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই।
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত হিউম্যান হলারের সংখ্যা পাঁচ হাজার ১৫৬টি।
বাস
কম খরচে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে বিভিন্ন ধরণের বাস।
এই বাসগুলো তিন ধরণের ব্যবস্থাপনায় চলে। লোকাল বাস, কাউন্টার বাস এবং সিটিং বাস।
সিটিং বাসগুলো সিট অনুযায়ী মাথা গুনে যাত্রী তুললেও অনেক সিটিং বাস নামে মাত্র সিটিং বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাউন্টার বাসগুলোয় মূলত টিকিট কেটে উঠতে হয়। সিট থাকুক আর নাই থাকুক কাউন্টারে যতজন যাত্রী থাকবেন তাদের বাসে তোলা হয়।
নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া যাত্রী ওঠানামার নিয়ম না থাকলেও অনেক বাসকেই এই নিয়ম ভাঙতে দেখা যায়।
তবে লোকাল বাস কোন ধরণের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না।
রাস্তার মাঝখানে যাত্রী নামানো উঠানো থেকে শুরু করে বেপরোয়া গতিতে চালানোর অভিযোগতো আছেই।
তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব গাড়িতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে চলাচল করতে হয়। বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ২৯ হাজার ২৩৪টি।
দোতলা বাস
ঢাকায় সীমিত সংখ্যক দ্বিতল বাস চলাচল করতে দেখা যায়। এর মধ্যে নারীদের জন্য বিশেষায়িত বাসও রয়েছে।
তবে এসব বাসের একটি বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধীনে কর্মচারীদের পরিবহনে ব্যবহৃত হয়।
ট্যাক্সি ক্যাব
অ্যাপভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
ভাড়ায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকায় যাত্রীরা চলাচলের জন্য বেছে নিচ্ছেন এই অ্যাপভিত্তিক পরিবহনগুলোকে।
এছাড়া পার্কিংয়ে জায়গা না থাকা, বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, ঢাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি না থাকাও এই ট্যাক্সিক্যাব কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত ট্যাক্সি ক্যাবের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৫৭০টি।
মিনিবাস/ মাইক্রোবাস
ঢাকায় মাইক্রোবাসগুলো ব্যক্তিগত পরিবহনের পাশাপাশি গণপরিবহন হিসেবেও ব্যবহার হতে দেখা যায়।
হাতিরঝিলে এক ধরণের লোকাল প্যাসেঞ্জার মাইক্রোবাস রয়েছে যেগুলোর ফিটনেস বলে কিছুই নেই।
ভেতরের সিটগুলো বসার অযোগ্য। আর এসব মাইক্রোবাসগুলো প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীদের ঠাসাঠাসি করে নিয়ে চলাচল করছে।
বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত মিনিবাস ও মাইক্রোবাসের সংখ্যা প্রায় ৮১ হাজার।
প্রাইভেটকার ও মোটর সাইকেল
ঢাকার যানজট ও গণপরিবহন স্বল্পতার কারণে ইদানীং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা।
কোন ঝুট ঝামেলা ছাড়া নির্দিষ্ট ভাড়ায় দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ায় ভালই ব্যবসা করে চলছে এই যানগুলো।
তারা মূলত প্রাইভেট কার ও মোটর সাইকেল সেবা দিয়ে থাকে।
ঢাকায় যানবাহনের পরিসংখ্যান:
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে মোট ১৯ ধরণের মোটর যানের কথা উল্লেখ করা হয়।
সেখানে দেখা যায় চলতি মাসের জুলাই মাস পর্যন্ত ১১ লাখ ৬০ হাজার মোটরযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে।
তবে ঢাকা মহানগরীতে কতগুলো অবৈধ যানবাহন চলাচল করে তার পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে।
গত বছরের দশম জাতীয় সংসদের চতুর্থ অধিবেশনে যানবাহনের একটি হিসাব তুলে ধরেছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, ঢাকা মহানগরীতে ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৩০৪টি যানবাহন চলাচল করছে। এর মধ্যে, ২১ হাজার ৬১৬টি বাস, মিনিবাস ৯ হাজার ৯শ’ ৪টি, প্রাইভেটকার ২ লাখ ৩০ হাজার ৩৩টি, মোটরসাইকেল ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭শ’ ৪৬টি। এছাড়াও অন্যান্য যানবাহন রয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫টি। দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটে ২৬৭টি বিআরটিসি বাস চলাচল করছে।
তাহলে সমাধান কী?
ঢাকা শহরে এই বিভিন্ন প্রকৃতির যানবাহনগুলোকে ব্যবস্থাপনায় আনার বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের সঙ্গে।
তিনি এসব যানগুলোকে ব্যবস্থাপনায় আনার ক্ষেত্রে রোড নেটওয়ার্ক ঠিক করার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার অনুপাতে রাস্তাঘাটের সংখ্যা কম। যে পরিমাণ আছে সেটারও অন্তত ২০ ভাগ বিভিন্ন ভাবে দখল হয়ে আছে।
এই সড়কগুলো পূর্ণভাবে চালু করা হলে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে এতো ভিন্ন প্রকৃতির যানগুলোর চলাচলে আলাদা লেন করার মতো প্রশস্ত রাস্তা সব জায়গায় নেই এবং ঢাকার বাস্তবতায় তা সম্ভব নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তবে অযান্ত্রিক যান, হালকা থেকে মাঝারি যান এবং ভারী যানবাহনের জন্য আলাদা লেন করতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা অনেকটাই ফেরানো সম্ভব বলে তিনি জানান।
নগরীতে যে হিউম্যান হলারগুলো চলছে এগুলো গণপরিবহন হিসেবে কতোটা নিরাপদ ? এমন প্রশ্ন রাখা হলে মিজানুর রহমান বলেন, হিউম্যান হলারগুলো মূলত সিএনজি, প্রাইভেটকার, জিপগুলোর মতো প্যারা ট্রানজিট ভেহিকেলের আওতাভুক্ত।
এই যানগুলোর নিরাপত্তা নির্ভর করে চালক ও গাড়ির ফিটনেসের ওপর। চালকের বৈধ লাইসেন্স থাকলে এবং গাড়িগুলো রাস্তায় চলাচলের উপযোগী হলে এগুলোকে বিপদজনক বলা যাবে না।
তবে নগরে যেসব ফিটনেসবিহীন মাইক্রোবাস চলছে সেগুলো তুলে দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
মিস্টার রহমান বলেন এ ধরণের গাড়ি কোন অবস্থাতেই নিরাপদ নয়।
এসব যানের কাগজপত্র নিয়মিত পরীক্ষার নিরীক্ষার পাশাপাশি কোন মাইক্রোবাস যদি গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাহলে সেগুলোর লাইসেন্সের পাশাপাশি আলাদা রুট পারমিট আছে কিনা পরীক্ষা করে নিতে হবে।
এদিকে ঢাকার বেশকিছু অলিগলিতে নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করে ব্যাটারিচালিত যান টুকটুক। এসব যানের না থাকে কোন বৈধ কাগজপত্র। না থাকে কোন নিবন্ধন।
এসব যানের চলাচল অবৈধ হলেও অল্প দূরত্বের পথগুলোয় দেদারসে চলছে টুকটুক।
পুলিশ মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে যানগুলো তুলে নিলেও কয়েকদিন পর পরিস্থিতি আগের চিত্রেই ফিরে যায়।
এছাড়া সড়কে বিশেষ করে মহাসড়কে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে তার পেছনে মূল কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করেন ব্যাটারিচালিত টমটম, নসিমন, করিমন জাতীয় নন স্ট্যান্ডার্ড যানগুলোকে।
মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে মহাসড়কদের থেকে এই যানগুলোকে সাময়িকভাবে সরানো গেলেও স্থানীয়দের ছত্রছায়ায় স্থায়ীভাবে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এক্ষেত্রে সড়ক ও মহাসড়কে পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের ওপর তিনি জোর দেন।
বিআরটিএ’র পাশাপাশি মূল দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশ নিলে এবং সেই সঙ্গে বিদ্যমান ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ করলে সড়ক ব্যবস্থা অনেকটাই শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
সুত্র- বিবিসি বাংলা
তথ্য সংগ্রহে- গিয়াস উদ্দিন/জিপি নিউজ-