জিপি নিউজঃ আগামী ৩০ শে জুলাই একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
এর আগে খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগের মধ্যেই এই তিন সিটির নির্বাচনে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন সব দলের মেয়র প্রার্থীরা।
কিন্তু এসব এলাকায় নির্বাচনের পরিবেশ এখন কেমন?
সব দলই কি প্রচারণার সমান সুযোগ পাচ্ছে?
সিলেটে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী অবশ্য অভিযোগ করছেন, সেখানে প্রচারণায় নামতে গিয়ে সরকারি দলের কাছ থেকে নানারকম বাধার মুখে পড়ছেন তারা।
এমনকি নির্বাচনকে ঘিরে দলে ও জোটের মধ্যে যে প্রকাশ্য বিভক্তি এর পেছনেও সরকারি দলের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ বিএনপি’র। যদিও তা নাকচ করে দিচ্ছে আওয়ামীলীগ।
কিন্তু সিলেটে নির্বাচনী পরিস্থিতি ঠিক কিরকম? আর সেখানে বিএনপি ও জোটের মধ্যে বিভক্তির তাৎপর্যই বা কতটা?
সিলেট নগরীতে ঢুকতেই নির্বাচনের উত্তাপটা বেশ টের পাওয়া গেল।
সবখানেই মেয়র প্রার্থীদের প্রতীক সম্বলিত পোস্টার-ফেস্টুনে ছেয়ে আছে।
সেগুলোতে যেমন দেখা যাচ্ছে আওয়ামীলীগের একক মেয়র প্রার্থীর ছবি, তেমনি বিএনপি’র প্রার্থীর পোস্টারও সবখানে দৃশ্যমান।
তবে একইসঙ্গে বাস প্রতীক নিয়ে বিএনপি’র একজন বিদ্রোহী এবং টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জামায়াত সমর্থিত একজন মেয়র প্রার্থীর পোস্টারও নজর কাড়ছে সবার।
আপাতত: সিলেটে এটা নিয়েই আলোচনা বেশি।
নগরীর কিনব্রিজ এলাকায় কথা হয় আব্দুল আলীমের সঙ্গে।
পেশায় ব্যবসায়ী এই ভোটার জানালেন, নির্বাচনটা এখন দ্বিমুখী থেকে চতুর্মূখী লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।
তিনি বলছিলেন, “আওয়ামীলীগ-বিএনপি’র সঙ্গে সঙ্গে এখন তো মাঠে আছে জামায়াতের প্রার্থী। এছাড়া বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থীও আছে। সবারই কিন্তু এখানে ব্যক্তিগত অবস্থান ভালো।”
ডলি আক্তার নামে একজন বললেন, বিএনপি-জামায়াতের আলাদা প্রার্থী থাকায় এখানে দুই দলই নিজেরা ক্ষতির মুখে পড়বে। লাভবান হবে আওয়ামীলীগ।
কিন্তু এরপরও কেন তাহলে বিএনপি-জামায়াত আলাদা প্রার্থী দিলো?
জামায়াতের সিলেট মহানগর আমীর ও মেয়র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের অবশ্য বলছেন, প্রার্থী নিয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপি’র সঙ্গে সমঝোতা ব্যর্থ হওয়াতেই সিলেটে আলাদা প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার দল।
”আমরা বিএনপিকে খুলনা-গাজীপুরে সমর্থন দিয়েছি। এরকম ১২টা সিটি করপোরেশনের মধ্যে আমরা শুধুমাত্র একটা সিটিতে তাদের সমর্থন চেয়েছিলাম। আমাদের টার্গেট ছিলো রাজশাহী অথবা সিলেট। আমরা তাদেরকে বরিশালের পাশাপাশি রাজশাহীতেও সমর্থন দিয়েছি। কিন্তু সিলেটে তাদের সমর্থন চেয়েও পাইনি। তাই এখানে আলাদাভাবেই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব,” বলছিলেন মি. জুবায়ের।
কিন্তু আলাদাভাবে নির্বাচন করে কতটা লাভবান হতে পারবে জামায়াত?
এতে করে কি জামায়াত-বিএনপি দুই দলের প্রার্থীরই হেরে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে না?
মি. জুবায়ের বলছিলেন, ”আমরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদি। আমরা এখানে অনেকদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়-পরাজয়ই সব না। এখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোন পরিবর্তন হয় না। রাজনীতির মাঠে আমাদের অবস্থা কেমন সেটা যাচাই করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগন আমাদেরকে কিভাবে সমর্থন দিচ্ছে সেটা যাচাই করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না আমরা।”
জামায়াতের স্থানীয় এই নেতার কথায় স্পষ্ট, বিভিন্ন কারণে কোণঠাসা এই দলটি এখন সিটি নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে নতুন করে একটা অবস্থান তৈরি করতে চায়।
সিলেটে তারা সেটি পাচ্ছেনও।
দেশের অন্যান্য এলাকায় দলটির নেতারা গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালালেও সিলেটে প্রকাশ্যে তারা দলীয় কার্যক্রম এবং প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।
আর এটাকেই সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী আমাকে বলেন, “আগে তাদের (জামায়াতের) অনেক অসুবিধা ছিলো। এখন কোন সমস্যা নাই। কেন নাই? রাজনীতিতে তো অনেক খেলা হয়। যারা তাদেরকে একসময় কাছে টেনে নিয়ে আবার দূরে ছুড়ে ফেলেছিলেন, তারা যে আবার কাছে টেনে নেন নাই তার কোন গ্যারান্টি নাই।”
মি. চৌধুরীর দাবি, সিলেটে জামায়াতের পাল্টা প্রার্থী নিয়ে মাঠে নামার পেছনে আছে সরকারি দলের কৌশল।
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপি’র জয় ঠেকানো।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনকে ঘিরে শুধু জামায়াত নয়, বিএনপি’র ভেতর থেকেও এসেছে পাল্টা প্রার্থীতা।
দলটির নগর সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম দল থেকে বহিস্কার হলেও প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেননি।
তবে দল ও জোটের এসব সমস্যাকে বাস্তবতা ধরেই সিলেটে বিএনপি এখন সবোর্চ্চ মনযোগ দিচ্ছে তাদের দলীয় ভোটব্যংক এবং সমর্থনে যেন এর কোন প্রভাব না পড়ে সেদিকে।
নগরীর কয়েকটি স্থানে দলটির মেয়র প্রার্থীর প্রচারণাতেও গিয়ে বাইরে থেকে নেতা-কর্মীদের বেশ উৎসব মুখর মনে হচ্ছিলো
তবে কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলতেই তারা জানান, একটা ভীতি কাজ করছে তাদের মনে।
কবির আলী নামে বিএনপি’র একজন কর্মী যিনি এর আগে ছাত্রদলের স্থানীয় নেতা ছিলেন, তিনি বলেন, “আমাদের অনেকেই তো রাতে বাসায় থাকতে পারি না। অন্য জায়গায় থাকতে হয়। যাদের নামে মামলা নাই কিংবা জামিনে আছে তাদেরও বাড়িতে তল্লাশি করা হচ্ছে।”
এর আগে খুলনা এবং গাজীপুরের নির্বাচন নিয়েও অনিয়ম এবং নেতা-কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখানোর অভিযোগ করা হয়েছিলো বিএনপি’র পক্ষ থেকে।
সেসব নির্বাচনে প্রশাসনিক নানা তৎপরতায় নেতা-কর্মীরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকতে না পারায় ধানের শীষ প্রতীকের পরাজয় ঘটে বলেই অভিযোগ দলটির।
সিলেটেও একই রকম পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে বলে দাবী করেছেন বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী।
”আওয়ামী লীগের লোকেরা আমাদের তৃণমূলে মেসেজ দিচ্ছে যে এত কষ্ট করে লাভ কী? খুলনা নিয়েছি, গাজীপুরও নিয়ে নেবো। এরকম কথা-বার্তা তারা ছড়াচ্ছে। যেন ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হন।”
তবে এসব অভিযোগকে খুব একটা পাত্তা দিতে চায় না আওয়ামীলীগ।
দলটির মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান প্রতিদিনই নেতা-কর্মীদের নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন নগরীর পাড়া-মহল্লা।
দলের সমর্থকেরাও আছেন উৎসবের আমেজে।
নির্বাচনী পরিস্থিতি এবং দলে ও জোটে বিভক্তির জন্য সরকারি দলের ইন্ধন নিয়ে বিএনপি’র যে অভিযোগ সে বিষয়ে কথা হয় মি. কামরানের সঙ্গে।
তিনি বলছিলেন, ”বিএনপি-জামায়াতের যে বিভক্তি, সেটা তাদের নেতৃত্বের ব্যাপার। আমরা সুশৃংখলভাবে আমাদের কাজ করছি। আমরা কেন তাদের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে যাবো? বিএনপি তো সবসময়ই নানারকম অভিযোগ করে। কিন্তু তারা কি একটাও প্রমাণ দিতে পারবে, আমরা কোথায় কিভাবে তাদের কার্যক্রমে বাধা দিয়েছি?”
মি. কামরান মনে করছেন, সিলেটে নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণই হবে। এবং সেই নির্বাচনে দলীয় শক্তি ও জনপ্রিয়তা দিয়েই জয়ী হতে চান তিনি।
যদিও বিএনপি, বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী, এমনকি জামায়াত সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে তাদের আশংকার কথাই প্রকাশ করছেন।
যেমন আশংকা এর আগে দেখিয়েছিলেন খুলনা ও গাজীপুরে বিরোধী দলীয় মেয়র প্রার্থীরা।
এবং শেষ পর্যন্ত সেসব নির্বাচনে তারা বিপুল ভোটে পরাজিতও হয়েছিলেন সরকারদলীয় প্রার্থীর কাছে।
সুত্র- বিবিসি