জিপি নিউজঃ টঙ্গীতে ঐতিহাসিক তুরাগ নদের তীরে শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে দাওয়াতে তাবলিগের ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এতে অংশ নিতে এর মধ্যেই মুসল্লিরা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। বুধবারই তাদের পদচারণায় ময়দানের অনেকাংশ মুখর হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার বাদ ফজর আমবয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হবে ইজতেমা। রবিবার জোহরের নামাজের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সম্মেলনের প্রথম পর্ব। ১৯ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। এরই মধ্যে ইজতেমার সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত সুবিশাল প্যান্ডেল, খুঁটিতে নম্বর প্লেট ও খিত্তা নম্বর বসানো হয়েছে। বিদেশি, জুড়নেওয়ালি জামাত, তাশকিল, মাস্তুরাত কামরাও প্রস্তুত। প্রস্তুত ওজু-গোসলের স্থানসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই। মুসল্লিদের সুষ্ঠুভাবে বয়ান শোনার জন্য পুরো মাঠে শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক দুই শতাধিক ছাতা মাইকসহ প্রায় ৪শ’ মাইক লাগানো হয়েছে। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা তুরাগ নদে ৭টি ভাসমান পন্টুন নির্মাণ করেছেন।
ইজতেমা উপলক্ষে সাত স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিক অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ময়দানে আসা-যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা আরোপ করা হয়েছে। তাদের ব্যাপারে বিশেষ নজরদারি রাখার নির্দেশ রয়েছে।
মুসল্লিদের অবস্থান : প্রথম পর্বে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা যেসব খিত্তায় অবস্থান করবেন তা হল- ঢাকা (খিত্তা ১-৮, ১৬, ১৮, ২০ ও ২১), পঞ্চগড় (৯), নীলফামারী (১০), শেরপুর (১১), নারায়ণগঞ্জ (১২ ও ১৯), গাইবান্ধা (১৩), নাটোর (১৪), মাদারীপুর (১৫), নড়াইল (১৭), লক্ষ্মীপুর (২২ ও ২৩), ঝালকাঠি (২৪), ভোলা (২৫ ও ২৬), মাগুরা (২৭) ও পটুয়াখালীর মুসল্লিরা ২৮নং খিত্তায় অবস্থান করবেন।
নিরাপত্তা : গাজীপুরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সাত স্তরের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এজন্য সাত হাজার সদস্য নিয়োজিত থাকবে। নিরাপত্তার জন্য ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার, ৪১ সিসি ক্যামেরা, নৌ টহল, আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেকটর দিয়ে তল্লাশি, বোম ডিস্পোজাল টিম ও ভিডিও ধারণ করা হবে। প্রতিটি খিত্তায় জেলা পুলিশের ৬ সদস্য সাদা পোশাকে নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া র্যাবের আড়াই হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের পক্ষ থেকে ৯টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। ১৪টি গাড়িসহ ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সতর্কাবস্থায় রাখা হবে।
পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস : গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নান জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের ওজু, গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ১৩টি গভীর নলকূপ ও ১৮ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিদিন ঘণ্টায় ৩ কোটি ৫৫ লাখ গ্যালন পানি সরবরাহ করা হবে। ইজতেমা চলাকালে ২৫টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিন-রাত বর্জ্য অপসারণ করা হবে। মশক নিধনের জন্য ২৪টি ফগার মেশিন কাজ করবে। এবারও নতুন করে ১ হাজার ২৯৬টিসহ প্রায় ৯ হাজার স্থায়ী টয়লেট, গোসল ও অজুখানা তৈরি ও মেরামত করা হয়েছে।
টঙ্গী বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম রব্বানী জানান, উত্তরা, টঙ্গী সুপার গ্রিড ও টঙ্গী নিউ গ্রিডকে বরাবরের মতোই মোট ১৩২ কেভি সোর্স হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, যাতে করে একটি গ্রিড অকেজো হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত না হয়। ৪টি ১১ কেভি ফিডার লাইন ও ২১টি বিতরণ কেন্দ্র করা হয়েছে। অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে ৪টি জেনারেটর সব সময় প্রস্তুত থাকবে।
২৪টি বিশেষ ট্রেন সার্ভিস : টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মো. হালিমুজ্জামান বলেন, এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের সুষ্ঠু যাতায়াতের জন্য ২৪টি বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করবে রেলওয়ে। শুক্রবার বাদ জুমা ঢাকা-টঙ্গী, টঙ্গী-ঢাকা এবং শনিবার লাকসাম-টঙ্গী বিশেষ ট্রেন চলবে। রোববার আখেরি মোনাজাতের দিন ভোর ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আপ মোনাজাত বিশেষ ৪ জোড়া এবং টঙ্গী-ময়মনসিংহ বিশেষ ২ জোড়া, ঢাকা-টঙ্গী ৪ জোড়া বিশেষ ট্রেন চলাচল করবে। শুক্রবার থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা অভিমুখী সব ট্রেন প্রায় ৪ মিনিট পর্যন্ত টঙ্গী স্টেশনে দাঁড়াবে।
চিকিৎসাসেবা : গাজীপুর সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘টঙ্গী ৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালকে ইজতেমার জন্য অস্থায়ীভাবে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ইউনিট চালু, স্যানিটেশন টিম এবং ১২টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাব, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ, ইবনে সিনা, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, র্যাব, ইমাম সমিতিসহ অর্ধশতাধিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহ করবে।
মিডিয়া সেন্টার : টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী ভূঁইয়া বলেন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রুনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে নিউ মুন্নু ফাইন কটন মিলস মাঠে টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাবের উদ্যোগে একটি অস্থায়ী মিডিয়া সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।
ইজতেমা কমিটি ও প্রশাসনের বক্তব্য : ইজতেমা আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩২ জেলার মুসল্লি এ বছর দুই দফায় ইজতেমায় অংশ নেবেন। তাবলিগ জামাতের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুতি ছাড়াও ডেসকো, তিতাস, ওয়াসাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থাগুলোও তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
টঙ্গী মডেল থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, চুরি, ছিনতাই রোধসহ মাদক ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ এবং এলাকার বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম বন্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কেএম জহুরুল আলম বলেন, ময়দানের আশপাশের অবৈধ স্থাপনা ও দোকানপাট উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়া ভেজালমুক্ত খাদ্য পরিবেশন নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।
১৯৬৭ সাল থেকে নিয়মিত বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে একই বছর ২ বার বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে নিয়মিত দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হচ্ছে।