জিপি নিউজঃ মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা ও পুলিশের সহিংস অভিযানের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ক্রমশই বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি ও দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা, মানবাধিকার কর্মী, বিভিন্ন দেশের নেতা ও নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
সোমবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জায়েদ রাদ আল হুসেইন বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, তাকে ‘যেন এক জাতিগত নিধনের আদর্শ উদাহরণ’। রাখাইন রাজ্যে ‘ভয়ানক সামরিক অভিযান’বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে চুপ ছিল। তারা রাখাইনে রাষ্ট্রীয় মদতে গণহত্যার প্রমাণ পায়নি বলে বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিথার নাউয়ার্ট সাংবাদিকদের জানান।
পরে মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা যেভাবে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের নাগরিকদের রক্ষা করছে না।
হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীকে আইনের শাসন মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। আমরা বলছি, এই সহিংসতা বন্ধ করুন। কোনো জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে যাতে আর ঘর হারাতে না হয় তা নিশ্চিত করুন।’
শনিবার ওআইসির এক সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, মিয়ানমারে আমাদের মুসলিম ভাইয়েরা অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করছে; তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি এই অন্যায় কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে আমাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
এরদোয়ান আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের জীবন নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা বন্ধ করতে আমরা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চাই। রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে মুসলিম দেশগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করতে এক জরুরি বৈঠক বসছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। কাল বুধবার ওই বৈঠক হবে। মানবিক কারণে যুক্তরাজ্য ও সুইডেন বুধবারের এ বৈঠক ডেকেছে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সরকারের বর্বর গণহত্যা ও ভয়াবহ দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা নিতে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট অবসানের জন্য মুসলিম দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপ বাড়াতে হবে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে মুসলিম সরকারগুলোকে মিয়ানমার সরকারের অপরাধের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কথা বলতে হবে।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বলেছেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানেরা নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডসহ পরিকল্পিত বর্বরতার শিকার। তার সরকার এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পেয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানের চরম বৈষম্যের শিকার এবং তাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়িতে ফিরে আসতে দেয়ার কোনো পথ খোলা রাখছে না মিয়ানমার সরকার।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, প্রকৃতপক্ষে পরিকল্পিত উপায়ে এসব করা হয়েছে এবং সে কারণে তাদের ওপর নির্যাতন, বৈষম্য, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো গণহত্যা দ্রুত বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে পাকিস্তান সরকার। প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান মন্ত্রিসভার বৈঠকে পাস করা একটি প্রস্তাবে গত ৮ সেপ্টেম্বর এ আহ্বান জানানো হয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রাখাইনে রোহিঙ্গা হত্যার বিষয়ে তীব্র নিন্দা জানায়।
সংস্থাটির ভাষ্য, ‘আমরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের জঘন্য সহিংসতা চালিয়ে যেতে দিতে পারি না।’ একই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হলাইংয়ের কাছে কয়েকটি দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
রবিবার সাংবাদিকদের কাছে বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামা বলেন, যারা রোহিঙ্গাদের আক্রমণ করছে, তাদের মনে রাখা উচিত, এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধ অবশ্যই দরিদ্র রোহিঙ্গা মুসলমানদের সহায় হতেন।
দালাই লামা বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার ঘটনায় তিনি খুবই মর্মাহত।
৭ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চিকে লেখা চিঠিতে শান্তিতে নোবেল জয়ী ৮৫ বছর বয়সী ডেসমন্ড টুটু লিখেছেন, ‘বোন, তোমার নীরবতার কারণ যদি মিয়ানমারের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার বিনিময়ে হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই এর মূল্য বেশ চড়া। যে দেশের নেতৃত্ব এক ন্যায়পরায়ণতার প্রতীকের হাতে, তার জন্য এটি বেমানান। তুমি যদি অটুট নীরবতায়ই নিজেকে অটল রেখে থাকো, তাহলে আমি বলব, এ নীরবতার দাম তোমার দেশের অসহায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দিতে হচ্ছে অনেক অশ্রু আর রক্তের মধ্য দিয়ে।’
শান্তিতে আরেক নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মানবাধিকারকর্মী মালালা বলেন, ‘হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা চুপ থাকতে পারি না।’
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছেন মালালা। সেখানকার নতুন জীবন নিয়ে খানিকটা নার্ভাস বলে জানালেন তিনি। সেই অক্সফোর্ডে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে গিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এ আহ্বান জানান।
মালালা বলেন, ‘এটি মানবাধিকার ইস্যু। সরকারের উচিত প্রতিক্রিয়া দেখানো। জনগণ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে। সহিংস অবস্থার মধ্যে তাদের বাস করতে হচ্ছে। এমন সহিংস অবস্থার মধ্যে বাস করাটা খুবই কঠিন। আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। এবং আমি আশা করব, অং সান সু চিও সাড়া দেবেন।’
রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের পদক্ষেপ না নেওয়ায় সু চি এখন বিশ্বব্যাপী সমালোচনায় পড়েছেন। রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্দলোন-বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শান্তির জন্য পাওয়া তার নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়ারও দাবি তুলেছেন কেউ কেউ।