জিপি নিউজঃ বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট শিল্পপতি, মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হারুনার রশিদ খান মুন্নু (৮৫) আজ মঙ্গলবার ভোর ৫টায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে দেশে-বিদেশে চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে অসুস্থতা বেড়ে গেলে তার মানিকগঞ্জের গিলন্ডতে নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত মুন্নু সিটিতে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুর খরব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে পুরো জেলায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শত শত মানুষ ছুটে আসছে মুন্নু সিটিতে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাড. গোলাম মহীউদ্দীনসহ দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ খবর পাওয়া মাত্র ছুটে যান তাকে দেখতে। তার বড় মেয়ে জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতা বিদেশে থেকে দেশে আসলে তাকে মুন্নু সিটিতে তার প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশেই দাফন করা হবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প। যেখানে পথের বাঁকে বাঁকে ছিল সংগ্রাম। টিকে থাকার লড়াই। জীবনের এমন নানান দোলাচলের মাঝেও তিনি টপকিয়েছেন ভাগ্যের সিঁড়ি। আর সারা জীবন ধৈর্যের এক দ্বীপশিখা হয়ে জ্বলছেন। নিজের সততার গুণে উপড়ে গেছে সব বাধা-বিপত্তি। নিজেকে আলোকিত করে রেখেছেন দেশবরেণ্য মানুষ বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং সাবেক মন্ত্রী হারুনার রশিদ খান মুন্নু। ছোট থেকে শুরু করেছিলেন ব্যবসা কিন্তু স্বপ্নটা ছিল আকাশ সমান। বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় তিনি নিজেই তার জীবনের গল্প বলেছেন অকপটে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার ভাঙন কবলিত আজিমনগর ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশর। তার জীবনের সংগ্রাম আর সফলতার বিভিন্ন বিষয় অনেকটা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। তার বয়স তখন দেড় বছর। পৃথিবীর কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই তিনি তার বাবাকে হারান। যখন একটু বড় হলেন তখন ভর্তি হন গ্রামের স্কুলে। ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন বলেই স্কুলের শিক্ষকরা তাকে আদর করতেন ও ক্লাসের সবার চাইতে বেশি ভালোবাসতেন।
গ্রামের ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে বাণিজ্য শাখায় প্রথম বিভাগ পেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর চলে যান ঢাকায়। ভর্তি হন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫৪ সালে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ডিপিআই অফিসে হিসাব শাখায় ৬০ টাকা বেতন আর ৩০ টাকা অ্যালাউন্সে একটি চাকরিও পান। বেতনের সেই টাকা থেকে মাসে ২০-৩০ টাকা করে বাড়িতে পাঠাতেন। তিনি যখন বি.কম ফার্স্ট ইয়ারে তখন মায়ের ইচ্ছা এবং পছন্দের পাত্রী হুরুন নাহার সঙ্গে ১৯৫৫ সালের ৩রা আগস্ট বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তার বয়স ছিল ২৩ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া অবস্থায় বেশ কয়েকটি ভালো চাকরির অফারও পান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বি.কম পাস করেন। এরপর চার্টার্ড একাউন্টস কোর্স সমাপ্ত করেন।
হারুনার রশিদ খান মুন্নু ১৯৫৮ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যখন অস্থির তখন লন্ডনে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির অফার এলেও মায়ের না চাওয়ার কারণে যাননি। তখন তিনি ব্যবসা করার জেদ ধরেন। আদমজীতে অডিটর হিসেবে কাজও করেন তিনি। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সেখানে অডিট করতেন। কিন্তু তার টার্গেট ছিল কিভাবে ব্যবসা শুরু করবেন।
দেশবরেণ্য ব্যবসায়ী হিসেবে হারুনার রশিদ খান মুন্নুর যেমন সুখ্যাতি রয়েছে, ঠিক রাজনীতিতেও তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে তার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। মানিকগঞ্জের বিএনপির রাজনীতিতে একজন প্রাণপুরুষ হিসেবে ছিলেন নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। শেষ পযর্ন্ত তিনিই একমাত্র জেলায় বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে নেতাকর্মীদের বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তিনি।
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাবেক মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ’৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন। মানিকগঞ্জে বিএনপির রাজনীতিতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠায় ২০০১ সালের নির্বাচনে একসঙ্গে মানিকগঞ্জ-২ আসন ও মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে জয়লাভ করেন। মন্ত্রীত্বও পান চারদলীয় জোটের সময়। জনপ্রিয় নেতা হিসেবে মানিকগঞ্জের প্রায় প্রত্যেকটি এলাকায় তার হাতের ছোঁয়া লেগেছে।