জিপি নিউজঃ অপহরণকারীরা আমার চোখের বাঁধন খুলে দিল। তারপর একটি নির্জন স্থানে নামিয়ে দেয়। তখন অল্প অল্প আঁধার নেমেছে। তারা আমাকে বাসের একটি টিকিট ধরিয়ে দেয় এবং বলে, ওই বাসটি আমাকে খুলনা থেকে ঢাকায় নিয়ে যাবে। সেখানে আমি কিছুটা সময় হাঁটাহাঁটি করি। খুলনায় একটি মার্কেটে পৌঁছি। সেখান থেকে কিছু খাবার কিনি। এরপর ৯টা ১৫ মিনিটে বাসে চড়ি।
লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার। বুধবার হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি এ সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারটি নেন গার্ডিয়ানের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক করেসপন্ডেন্ট মাইকেল সাফি।
ফরহাদ মজহার আরো বলেছেন, তাকে অপহরণের জন্য প্রকৃতপক্ষে কারা দায়ী সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। তার ভাষায়, আমার অপহরণকারীরা ছিল সাদা পোশাকে (প্লেন ক্লোথ)। তারা কারা ছিল বা কোন গ্রুপের ছিল তা আমি জানি না।
ফরহাদ মজহার বলেছেন, তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কণ্ঠ রোধ করা যাবে না। তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে সোচ্চার থাকবেন। এ বিষয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অনলাইন গার্ডিয়ান।
এতে বলা হয়েছে, ফরহাদ মজহার বাংলাদেশ সরকারের একজন সমালোচক। তিনি অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন নেতাকর্মী ও বিরোধী দলীয় নেতাদের অপহরণের যে ধারা চলছে তারই সর্বশেষ শিকার তিনি। তবে তাকে এর মাধ্যমে কণ্ঠরোধ করা যাবে না। অপহরণের দিনে কি ঘটেছিল তিনি সে বর্ণনা দিয়েছেন গার্ডিয়ানকে।
বলেছেন, গত সপ্তাহে বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পরই তিনজন ব্যক্তি তাকে জোর করে একটি মিনিবাসে ওঠায়। এর প্রায় ১৬ ঘন্টা পরে ঢাকা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে একটি শহর থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। গত সোমবার তার এই নিখোঁজ হওয়ার খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। এতে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দেয়। বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ জানায় জাতিসংঘও। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলে, এসব গুমের জন্য বেশির ভাগ দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা।
গার্ডিয়ান লিখেছে, অপহরণের পর ঢাকায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে গার্ডিয়ানকে দেয়া এটিই তার এ বিষয়ক প্রথম সাক্ষাৎকার। তিনি এর আগে দেশের বা বিদেশি কোনো মিডিয়াকে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো সাক্ষাৎকার দেননি। এ সময় তিনি বলেছেন, অপহরণকারীরা খুব কর্কশ ভাষা ব্যবহার করেছে। আমার মোবাইল ফোন নিয়ে গিয়েছিল। আমার চোখ বেঁধে ফেলেছিল। তারপর তাদের হাঁটু দিয়ে আমাকে মিনিবাসের ফ্লোরের ওপর চেপে ধরে রেখেছিল।
তার নিখোঁজের খবর যখন রহস্যময় হয়ে ওঠে তখন পুলিশ ঘোষণা করে, তিনি ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর খুলনার কাছে একটি বাস থেকে উদ্ধার করেছে ফরহাদ মজহারকে (৬৯)। তিনি গত এক সপ্তাহ পুলিশি প্রহরায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর হিসাব মতে, গত তিন বছরে বাংলাদেশে গুম হয়েছেন প্রায় ২২৩ জন মানুষ। তার মধ্যে ১৮ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সে বিষয়ে কেউ মুখ খোলেনি। ৩১ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এদের পরিবারসহ অন্য গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলো ২০১৪ সালের জুলাই থেকে নীরবতা বজায় রাখছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অধিকার-এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান বলেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো এ নিয়ে কথা বলতে শঙ্কিত। কারণ, তাদের ভয় পরিবারের অন্য সদস্যরাও একই পরিণতি ভোগ করতে পারেন।
বুধবার ফরহাদ মজহার বলেছেন, গত সপ্তাহে সকাল প্রায় ৫টার দিকে তার বাসার কাছের রাস্তা থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। তারা কারা তা তিনি নিশ্চিত নন। তার ভাষায়, ওইদিন সকালে আমার চোখে সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমি ওষুধ কেনার জন্য বাসা থেকে বের হই। অকস্মাৎ তিনজন মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে একটি সাদা মিনিবাসে তুলে নেয়।
তিনি বলেন, এ সময় তিনি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করতে সক্ষম হন এবং স্ত্রীকে ফোন করেন। ফরহাদ মজহার বলেন, (আমার স্ত্রীকে দেয়া) ওই ফোনকলটি ছিল একটি শর্ট কল। আমি তাকে শুধু বলতে পেরেছি, তারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা আমাকে হত্যা করবে। বিষয়টি অপহরণকারীরা টের পাওয়ার আগে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি সামান্য সময়।
তিনি বলেছেন, অপহরণকারীরা তার চোখ বেঁধে ফেলে এবং তার মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেয়। তিনি যদি তার স্ত্রীকে আবার ফোন করেন, তিনি কোথায় আছেন পুলিশ তা ট্র্যাক করতে পারবে এটা মনে করে তিনি তাদের মুক্তিপণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। ‘এরপরই তারা আমাকে ফোনটি দিয়ে দেয়। এ নিয়ে আমি কয়েক বার আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি’।
‘বাসটি কয়েক ঘণ্টা চলতে থাকে। এ সময়ে তারা আমাকে নানাভাবে নির্যাতন করে। মাঝে মাঝেই আমার প্রতি আজেবাজে ভাষা ছুড়ে দিতে থাকে। তারা আমাকে থাপড় দেয়। প্রায় ১০ বা ১২ ঘণ্টা পরে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে। এ সময় তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়। একটি নির্জন স্থানে নামিয়ে দেয় আমাকে। তখন কিছুটা অন্ধকার হয়ে এসেছে। এরপর তারা আমাকে একটি বাসের টিকিট ধরিয়ে দেয়। আমাকে বলে ওই বাসে করে খুলনা থেকে ঢাকায় ফিরে যেতে। তখন আমি কিছুটা পথ হেঁটে আসি। খুলনায় একটি মার্কেটে পৌঁছি। রাত ৯টা ১৫ মিনিটে বাসটিতে ওঠার আগে সেখান থেকে কিছু খাবার কিনি। আমাকে যখন জিম্মি রাখা হয়েছিল তখন আমি আমার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছি। মাইক্রোবাসটি ঢাকা ছাড়ার পর আমার এসব মোবাইল কলের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ আমার অবস্থান নির্ণয় করতে পারতো। এভাবেই আমাকে পরে উদ্ধার করা হয়েছে। তবে আমি বিস্মিত, মাইক্রোবাসটি খুলনায় পৌঁছানোর আগে কেন পুলিশ মাইক্রোবাসটি ইন্টারসেপ্ট করতে পারলো না।
ফরহাদ মজহার বলেছেন, এখনও তিনি প্রচণ্ড রকম মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুস্থ হতে তার অনেকটা সময় লাগবে। তার ভাষায়, তবে আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা প্রকাশ করতে আমি মোটেও ভীত নই। জোরপূর্বক নিখোঁজের পর যেসব মানুষ জীবিত ফিরে আসেন তারা পরে রহস্যজনক কারণে নীরবতা অবলম্বন করেন। যখন আমি কাজে ফিরবো তখন এ ইস্যুতে কাজ শুরু করবো। জোর করে এমন গুমের সংস্কৃতি আমাদেরকে বন্ধ করতে হবে।
ঢাকার পুলিশ এ মামলাটি তদন্ত করছে। তবে কর্মকর্তারা স্থানীয় মিডিয়াকে বলেছেন, ফরহাদ মহজারের দেয়া তথ্য নিয়ে তারা সন্দিহান। একজন কর্মকর্তা বুধবার ডেইলি স্টারকে বলেছেন, তিনি যে মাইক্রোবাসে করে খুলনা গিয়েছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।
গত সপ্তাহে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাতে অভিযোগ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার গোপনে আটক করে রেখেছে কয়েকশ’ মানুষকে। এর বেশির ভাগই মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, যারা ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা করে।
নিউইয়র্কভিত্তিক এ সংগঠন বলেছে, গত বছরেই শুধু আটক করে গোপনীয়ভাবে আটকে রাখা হয়েছে কমপক্ষে ৯০ জনকে। বেশির ভাগকেই আদালতে হাজির করা হয়েছে। তবে ২১টি ঘটনায় বন্দিকে হত্যা করা হয়েছে। ৯ জন কোথায় আছেন সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, অল্প কিছু মামলার তদন্ত করা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের লোকজন অবৈধ এসব আটকের জন্য দায়ী এমন অভিযোগ আমলে নেয় না পুলিশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।