জিপি নিউজঃ ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ কুমিল্লার খাদি শিল্প আদি ও অনন্তকাল ধরে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয়। পোশাকপ্রেমী ও সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে ‘কুমিল্লার খাদি’ একটি অতি পরিচিত ব্রান্ড। প্রথম দিকে সংগ্রামী খেটে খাওয়া, গরিব, মাটি ও মানুষের পছন্দের পোশাক ছিল কুমিল্লার খাদি। শতবর্ষের লালিত ঐতিহ্যের খাদি মূলত আলোচনায় আসে ১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে গোটা ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র ব্রিটিশদের হটাও রব পড়ে যায়। সেই আন্দোলনের সময় বিদেশী পণ্যগুলো বর্জনেরও হিড়িক পড়ে যায়। আন্দোলন মুখর ক্রান্তিকালীন সেই সময়ে কুমিল্লার খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তখন স্লোগান ছিল- ‘বিদেশী পণ্য বর্জন করো, মোটা ভাত মোটা কাপড় গ্রহণ করো। মজার বিষয় হচ্ছে, কুমিল্লার খাদি নামকরণ নিয়েও চমকপ্রদ কথার চল রয়েছে। খাদি কাপড়টি প্রথম দিকে অন্য নামে পরিচিত ছিল। প্রথমত খাদি কোনো কাপড় বা সুতারও নাম নয়।
দেশীয় তাঁত শিল্পে এ কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা ও প্রসার বেড়ে যাওয়ায়, পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে মাটিতে এক ধরনের গর্ত বা খাদ করা হতো। এই গর্ত বা খাদ থেকে উৎপন্ন হতো বলেই, তাকে খাদি কাপড় বলা হয়। পরে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অত্যাধুনিক মেশিনে তৈরি হলেও খাদি নামেই পরিচিতি অটুট থাকে।
একটা সময় এ দেশীয় কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে দেশীয় প্রায় সব পণ্য বিদেশেও প্রচুর রফতানি হতো। ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবক’টি দেশে দেশীয় পণ্য অবাধে রফতানি হতো। এখনো যে হচ্ছে না, তা নয়। শুধু তাই নয়, দেশীয় কাপড়চোপড়, রেশন থেকে শুরু করে সব কিছুর চাহিদাও ছিল তখন তুঙ্গস্পর্শী। খাদি শিল্পের সাথে জড়িত মালিক শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরাও দিনরাত বিরামহীন ঘাম ঝরানো অক্লান্ত পরিশ্রম করত। উন্নতমানের তুলা থেকে সংগৃহীত সুতা দিয়ে তৈরি হতো দৃষ্টিনন্দন খাদি। প্রথম দিকে সংগ্রামী ও গরিব মানুষের কাপড় হিসেবে অধিক পরিচিতি থাকলেও পরে মোটা সুতা চিকন ও মিহি হয়ে যায়। শিল্প ও নান্দনিকতার ছোঁয়া লাগে খাদির প্রতিটি ইঞ্চির পরতে পরতে। পোশাকপ্রেমী তরুণ-তরুণী ও বয়স্করা শখের বশে পড়তে থাকে কুমিল্লার খাদির পোশাক। ঈদ, পূজা ও পার্বণের পাশাপাশি নববর্ষেও ব্যাপক চাহিদা থাকত খাদিজাত পোশাক সামগ্রীর।
একটা সময় বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার খাদি শিল্প। কুমিল্লার কান্দিরপাড়স্থ ঐতিহ্যবাহী খাদি বস্ত্রবিতানের অন্যতম কর্ণধার ফেরদৌস হোসেন খন্দকারের সাথে কথা হয়। প্রায় ১৭ বছর ধরে তিনি এ পেশায় আছেন। বর্তমানে খাদির অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে একটু বাড়লেও, যতটা বাড়ার দরকার ততটা বাড়েনি। যদিও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সারা বাংলাদেশ থেকে এখানে আসছে। আগ্রহ দেখাচ্ছে।
তার মতে, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, কক্সবাজার, রংপুরসহ প্রায় সারা দেশেই খাদির চাহিদা আছে।
আর বিদেশের বাজারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদেশের বাজারেও মোটামুটি খাদির চাহিদা মন্দ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশেই খাদির তৈরী পোশাক রফতানি হচ্ছে। সমস্যা হলো, আগের তুলনায় পরিবহন খরচটা প্রায় দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। প্রতি কেজি কাপড়ের বিপরীতে প্রায় ১৫০০-২০০০ টাকা খরচ গুনতে হয়। এখানেই আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে যাচ্ছে।
-কোন ধরনের পোশাকের বাজারে চাহিদা বেশি?
-পুরুষের পায়জামা পাঞ্জাবি, ফতুয়া ও শার্টের পাশাপাশি মহিলাদের শাড়ি থ্রিপিস ও সেলোয়ার কামিজ।
-কুমিল্লার চান্দিনা,রামচন্দ্রপুর ও দেবপুরকে ঘিরে মুলতঃ বৃহৎ খাদি পল্লী গড়ে ওঠেছে।
-ইতিহাস ঐতিহ্যেসমৃদ্ধ এ শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবশ্য তার আশা ততটা নেই। তার মতে, এখন দেশীয় বাজারে বিদেশী কাপড়ে সয়লাব। নতুন প্রজন্ম ওদিকে ঝুঁকে পড়েছে। এভাবে অব্যাহত চলতে থাকলে এই শিল্প অচিরেই হারিয়ে যাবে। যদিও এ শিল্পের সাথে যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে করছি। কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, আর্থিক সাহায্য ও মানুষের বিদেশী পোশাকনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তনই পারে এ শিল্পটাকে বাঁচাতে।
কুমিল্লার খাদি শিল্প আজ ক্রমশ হারিয়ে যেতে চলেছে। একসময়ের এই পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকে আজ আর্থিক অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে এখন অন্যান্য পেশা বা ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কেউ কেউ আবার এ শিল্পটাকে পরম যত্ন, ভালোবাসা ও আবেগে বুকে আগলে ধরে এখনো মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। অথচ একটুখানি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্যের খাদি বা খদ্দর শিল্পকে বাঁচাতে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সর্বাগ্রে আমাদের সবচেয়ে বেশি সচেতন ও কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে।
কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি শিল্প

Facebook Comments