জিপি নিউজঃ গুম হওয়া ব্যক্তিরা কোথায় কি অবস্থায় আছেন, তাদের পরিবারের কাছে এ প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য সরকার। সরকারের হাত যদি পরিষ্কার থাকে তাহলে তাদের তো গুম নিয়ে তদন্তে শঙ্কিত হওয়া উচিত নয়।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে অব্যাহতভাবে গুম হচ্ছে। তবে সরকার এমন অভিযোগ অস্বীকার করে। এক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন অন্য কথা।
তারা বলেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন এজেন্সি এসব গুমের জন্য দায়ী। আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষ্যে একটি যৌথ বিবৃতিতে এসব কথা বলেছে কয়েকটি মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, দ্য এশিয়ান ফেডারেশন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস, দ্য এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং অধিকার।
বিবৃতিতে তারা বলেছে, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে জোরপূর্বক গুম হলো মনবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যা ক্ষমতাসীন সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে চলছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৮৮ জনকে গুম করার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে গুম হওয়ার পরে ৫১ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন স্থানে চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়েছে ১৯৩ জনকে। গুম হওয়ার অনেক পরে কিছু লোককে আদালতে নেয়া হয়েছে। দেখানো হয়েছে তাকে বা তাদেরকে ক্রিমিনাল কেসে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি ১৪৪ জন গুমের শিকার মানুষ কোথায় সে বিষয়ে কেউ কিছু জানে না।
বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, এসব সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে। কারণ, এমন ঘটনার শিকার অনেকে, অনেক নির্যাতিতের পরিবার প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে কথা বলেন না। তাদেরকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে হুমকি, ভয়ভীতি দেখানো হয়।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের অভিযোগ ও তাদের আনুষ্ঠানিক মামলা, রিট পিটিশন আদালতে দায়ে করা হয়েছে। এতে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ও আধাসামরিক বাহিনীকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে অপহরণকারীরা বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্ধারিত পোশাক পরে এবং তাদের ব্যবহৃত গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছেন। তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে র্যাবের সদস্য, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি হিসেবে।
যেসব ব্যক্তি তাদের হাত থেকে ফিরে এসেছেন তারা বলেছেন, তাদের সবাইকে থানায় অথবা র্যাবের কোনো অফিস বা ক্যাম্পে অথবা অজ্ঞাত কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে নির্ধারিত পোশাক পরা ব্যক্তিরা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
ঘটনার শিকার অনেকেই বলেছেন, তাদেরকে চোখ বেঁধে রাখা হতো। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে নিয়ে রাখা হতো নতুন কোনো স্থানে। এমন ঘটনার শিকার যারা হয়েছেন তাদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। যে ব্যাপক হারে বার বার এসব ঘটনা ঘটছে তাতে এটা অনুধাবন করা যায় যে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অজ্ঞাতসারে বা তাদের অনুমোদন ছাড়া এ ঘটনা ঘটছে না। সরকারি কিছু কর্মকর্তা যে সরাসরি এতে জড়িত তার প্রমাণ মিলেছে। তেমনই একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো। ২০১৭ সালের ৪ঠা জুলাই সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন সাতক্ষীরার সিনিয়র বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুল্লাহ মাহমুদ।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক শেখ মোখলেসুর রহমান ওরফে জনিকে গ্রেপ্তার ও তার পরে গুমের ঘটনায় পুলিশের তিনজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জড়িত বলে বলা হয়েছে ওই তদন্ত রিপোর্টে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা গুমের বিষয়ে তদন্তে দেখতে পেয়েছেন যে গ্রেপ্তার করা কিছু মানুষকে পরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বাকি কিছুকে পরে আদালতে তোলা হয়েছে। তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিছুদিন পরে কেউ কেউ বাড়ি ফিরে যেতে পেরেছেন। বাকিরা কোথায় তা সনাক্ত করা যায় নি এখনও।
ওই রিপোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট মোখলেসুর বলেছেন, ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে তুলে নেয়া ও সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি বার বার অস্বীকার করেছে পুলিশ। বিচার বিভাগীয় এই তদন্তে দেখা গেছে, গুমের সঙ্গে জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এজেন্টরা। অন্যদিকে এসব ঘটনায় অভিযোগ অথবা মামলা রেকর্ড করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পুলিশ। এর মাধ্যমে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে মারাত্মকভাবে অবহেলা করেছে পুলিশ বিভাগ। বাংলাদেশে এমন মামলার বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন মানবাধিকারের পক্ষের লোকেরা। তাদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। না হয় হুমকি দেয়া হয়েছে। এমন কি তাদের ওপর সরকার, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এজেন্সিগুলো নজরদারি ও হয়রান করেছে।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকেও দীর্ঘদিন ভীতি প্রদর্শন, জীবনের হুমকি দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে ন্যায়বিচার চাওয়া অথবা এ বিষয়ে কথা বলার বিরুদ্ধে অনুৎসাহিত করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা যেসব পরিবারে সত্য সন্ধানে গিয়েছেন, সেই পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেই বেশির ভাগ এমন হুমকি দেয়া হয়েছে। যদি তারা প্রকাশ্যে গুম নিয়ে কোনো কথা বলেন অথবা এ বিষয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করতে যান তাহলে এসব পরিবারকে করুণ পরিণতি ভোগের বিষয়ে সতর্ক করা হয়। এক্ষেত্রে ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজনদেরকে সরাসরি অথবা অজ্ঞাতনামা কারো মাধ্যমে অথবা ফোনে হুমকি দেয়া হয়।
তাদেরকে বলা হয়, এসব ঘটনা প্রকাশ্যে গেলে, মিডিয়াকে জানালে তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা গুম করা হবে। তবে রাষ্ট্রের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা দাবি করেন, ভিকটিম পালিয়েছেন অথবা অপরাধীরা তাকে অপহরণ করেছে। তারা সরাসরি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ অস্বীকার করেন। এসব নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকে সব গুমের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের আহ্বান থাকা সত্ত্বেও, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তারা উল্টো মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোকে দায়ী করেন।
ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের ওয়ার্র্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি) এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কাউন্সিলকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুধাবন করা জরুরি। তাদেরকে অনুধাবন করতে হবে যে, বাংলাদেশের মানবাধিকারের সমস্যা সরাসরি রাজনৈতিক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ও কৌশল আগলে রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই ডব্লিউজিইআইডি সহ দ্য স্পেশাল প্রোসিডিউরকে আবার নতুন করে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত।
ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এটা মেনে নিতে হবে যে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রই শুধু গুম ও অন্যান্য ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের শাসন অব্যাহত রাখতে অবশ্যই বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করতে হবে, যা এই মুহূর্তে নেই।